asd
Homeদেশজুড়েপ্রান বৈচিত্রময় কুড়িয়ে পাওয়া শাকের সাতকাহন লেখক মোঃ মোজাফফর হোসেন উপপরিচালক (এএসসি)...

প্রান বৈচিত্রময় কুড়িয়ে পাওয়া শাকের সাতকাহন লেখক মোঃ মোজাফফর হোসেন উপপরিচালক (এএসসি) বিএডিসি, দিনাজপুর।

গ্রামীণ অপুষ্টি দূরীকরণে বরাবরই ভূমিকা রাখছে কুড়িয়ে পাওয়া উদ্ভিদবৈচিত্র্য গুলো। বাংলাদেশের খাল-বিল, নদী-নালা, পতিত জমি, বাড়ির আশপাশেই রয়েছে এসব উদ্ভিদবৈচিত্র্য গুলো যা মানুষের খাদ্যদ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এদের মধ্যে মানুষের জন্য কুড়িয়ে পাওয়া শাক অন্যতম। আবার যেগুলো মানুষ খায় না সেগুলো পশু খাদ্য হিসেবেও স্বীকৃত। এসব উদ্ভিদবৈচিত্র্য গুলো থেকে কুড়িয়ে পাওয়া শাক সংরক্ষণ যেমন জরুরি, তেমনি এর ব্যবহারও বাড়ানো দরকার। মূলত এসব উদ্ভিদবৈচিত্র্য গুলোর মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া শাক সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণ কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি এবং উদ্ভিদবৈচিত্র্য সনাক্তকরণ, শ্রেণিকরণ, সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও ব্যবহার বৃদ্ধি জরুরি।

নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা “বাঙালীর ইতিহাস” গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে প্রাচীনকালে গ্রামের গরিব বাঙালির অন্যতম প্রধান খাবার ছিল শাক। ষোড়শ শতকের চৈতন্যকাব্যগুলিতেও বাঙালির খাবার হিসেবে শাকের উল্লেখ রয়েছে। প্রত্যেক মৌসুমে আমাদের দেশে গ্রামের পতিত জমি, পুকুর পাড় জমির আইলে কোন না কোন প্রকার শাক পাওয়া যায়। বিশেষ কিছু রোগের ক্ষেত্র ছাড়া এ সব কুড়িয়ে পাওয়া শাক দুনিয়ার সব প্রান্তের পুষ্টিবিজ্ঞানীদের কাছে খাদ্যতালিকার আদরণীয় ও আবশ্যক বস্তু তা আমরা অনেকেই জানি। আর বাঙালির পাতে শাকের গুরুত্ব চিরকালীন।
আমাদের আশেপাশের কুড়িয়ে পাওয়া এসব অচাষকৃত শাকসবজি পুষ্টির ভন্ডার। এগুলো সংরক্ষণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে পারিবারিকভাবে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব। সাথে সাথে এসব অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্যের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানা দরকার। এ দেশের মাটি বড় উর্বর। সে কারণেই বুঝি যত্র তত্র বেড়ে উঠে রকমারি গাছগাছালি। আমাদের এ ছোট জনপদে বৃক্ষ, গুল্ম বিরুৎ তিন রকমের গাছগাছালির দেখা মেলে। প্রকৃতির নিদর্শন সরুপ মহান আল্লাহ তায়ালা, তার উদার হস্তে যেন এসব সম্পদ আমাদের দান করেছেন। এদের আমরা নষ্ট করছি আমাদের অদূরদর্শি কর্মকান্ড আর অতি দূর্বল ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে । হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের খাদ্যের নানা উপকরণ হিসেবে এসব প্রাকৃতিক গাছগাছালি আমাদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে। গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষেরা আজও কুড়িয়ে নিচ্ছে কত প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জের লতাপাতা, ফল-মূল কিংবা বীজ-কন্দ।

কত রকমের শাক রয়েছে ; যাদের যত্ন করে উন্নত কৃষি প্রযুক্তির সহায়তায় অর্থ খরচ আবাদ করে খাবার উপযোগী করেতে হয়। কিন্তু আমাদের অনেক শাক রয়েছে যার কিনা কৃষি প্রযুক্তির ছোয়া ছাড়াই প্রাকৃতিক পরিবেশে একা-একাই জন্মায় বেড়ে উঠে। অথচ এদের নির্দিধায় আমরা শাক হিসেবে সংগ্রহ করি । গ্রাম বাংলার বহু পরিবারে অনাবাদি এসব শাক খাদ্যের এক অনিবার্য অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের হাত বা মমতা কিংবা কোন যত্ন ছাড়াই এরা প্রাকৃতিক পরিবেশে বংশ বিস্তার করে, বেড়ে ওঠে। মানুষ এদের সংগ্রহ করে নেয় শুধু তার নিজের প্রয়োজনে প্রকৃতির ভান্ডার থেকে। সে অর্থে এদের ‘বুনো/জংলী’ শাকও বলা যায়। মানুষ এদের উন্নত পরিবেশে কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নয়ন ঘটাবার তেমন কোন আয়োজন করেনি কখনো। বরং উন্নত পরিবেশে এদের বেমানান বলে মনে হয়। ফলে হঠাৎ পরিবর্তন (মিউটেশন) বা প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়া অনেকটাই অবিকৃত থেকে গেছে এদের অবয়ব, এদের স্বাদ ও গন্ধ। তাই চেনা জানা এসব শাক সংগ্রহ করে সেই স্বাদ -সেই গন্ধ অনায়াসে গ্রহন করতে পারি আজও।

গ্রাম বাংলার মাঠে ঘাটে, পতিত জমিতে, পানি সেচের নালায়,ক্ষেতের আইলে, আবাদি -অনাবাদি জমিতে কত ভিন্ন ভিন্ন রকম শাকের সন্ধান মেলে যা আমাদের অবাক করে দেয়। স্বাদে-গন্ধে এরা একটা অন্যটা থেকে কত অনন্য। গ্রাম বাংলায় আদি বাসস্থানে অনাবাদি শাকের সংখ্যা ষাটোর্ধ কম হবে না। উবিনিগের এক গবেষণায় টাঙ্গাইল, ঈশ্বরদী এবং কক্সবাজারে এরকম অনাবাদি তেতাল্লিশটি কুড়িয়ে পাওয়া শাকের সন্ধান মেলে। আর আবাদি কিন্তু কুড়িয়ে পাওয়া যায় আরও তেত্রিশটি শাকের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। স্থান কাল পাত্র ভেদে এসব শাকের জন্মানোর প্রকৃতি ও মানুষের খাদ্যাভাস এর উপর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে পুষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষায়। সারা দেশের আনাচে কানাচে পাওয়া যায় এমন শাক রয়েছে বেশ কয়েকটি। এগুলো হলো- হেলেঞ্চা শাক, ঢেঁকি শাক, নটেশাক, গিমাশাক, তেলাকুচা, থানকুনি, খানকুন, বথুয়া, বন কচু, গন্ধভাদালী, কাটানটে, কলমি, দন্ডকলস, নুনিয়াশাক, শুশনি শাক, শিয়ালমুতি, বনপাট ইত্যাদি। এসবের বাইরেও রয়েছে আরো কত অনাবাদি শাক। স্থানভেদে এদের কোন কোনটা জন্মে অন্যটির চেয়ে অনেক বেশি। সেরকম শাকগুলোর মধ্যে রয়েছে পিপুল, আমরুল সেঞ্চি, মোরগ শাক,কানাইশাক, নুন খুরিয়া, বিষ কচু, দুধলী, রসুন শাক, ক্যাথাপাটা, চিরকুটি, কাটা কচু, নিলিচি, মুনসি শাক, হরি শাক, থ্যানথ্যানে, গিন নারিস, খ্যাটখ্যাটি, চুকাকলা, হুটকা, পানিভাঙ্গা, হাগড়া,চিনিগুড়ি, মরিচপাতা, বনঝুড়ি, বনকচু ইত্যাদি।

এরকম কুড়িয়ে নেওয়া গাছগাছালির সংখ্যা পাহাড়ি জনপদে নিতান্তই কম নয়। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় জুম চাষ থেকে পাওয়া ফসলের বাইরেও তারা সংগ্রহ করে নিচ্ছে উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে নানা রকম খাদ্য। এতসব বৈচিত্র্যময় প্রজাতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে বলেই পাহাড়ী জনগোষ্ঠি নানা রকম পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারছে। প্রায় পঞ্চাশ রকম নানা প্রাকৃতিক উদ্ভিদ প্রজাতির লতাপাতা তাদের খাদ্য তালিকায় তারা অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। তাদের যে কায়িকশ্রম দানের ক্ষমতা, ধৈর্য্য ও মেধা বুঝি এই ভিন্নতর উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণেরই ফলাফল।

এত যে ভিন্ন ভিন্ন সব শাক এদের সকলের আবাসস্থল আবার এক রকম নয় অর্থাৎ কোন কোনটার আবাসস্থল এক রকম তো অন্য কোন কোনটার আবার অন্যরকম। রাস্তার আঙ্গিনায়, বাড়ির আশেপাশে দেখা মিলে সেরকম শাকের মধ্যে রয়েছে ঢেঁকি শাক, মোরগ শাক, গিমা শাক, পিপুল, কানাই শাক, রসুন শাক, কাটানটে, খ্যাটখ্যাটি, মরিচপাতা ইত্যাদি শাক। উঁচু জায়গাতে জন্মায় তেমন শাকের মধ্যে রয়েছে নটে শাক, গন্ধভাদালী, চিরকুটি ইত্যাদি। স্যাঁতস্যাঁতে এলাকা পছন্দ করে সেঞ্চি শাক, নিলিচি, মুনসি শাক, বন কচু, চিনিগুড়ি ইত্যাদি। রোদ কিন্তু ভেজামাটি পছন্দ করে তেমন শাকের মধ্যে রয়েছে নুনিয়া শাক, আমরুল, বনপাট এসব শাক। শুকনা স্থানে খানিকটা বৃষ্টির পানি পেলে গজায় গিননারিস, চুকাকলা, বনঝুড়ি ইত্যদি। কস্থরি, থানকুনি, হুটকা এসব শাকের আবার পছন্দ খানিকটা ছায়াযুক্ত স্থান। আবাদি জমিতে অন্য ফসলের মাঠে আগাছা হিসেবে গজায় তেমন শাকের মধ্যে রয়েছে নুন খুরিয়া, দুধলী, দন্ডকলস, শুশনী শাক, শিয়ালমুতি, থ্যানথ্যানে, হুটকা ইত্যাদি শাক। ঝোপ জংগলে গজায় তেমন শাকগুলো হলো- তেলাকুচা, বিষ কচু ইত্যাদি শাক। ডোবা স্থানে, পানিতে, ভেজাস্থানের আশেপাশে যেসব শাকের দেখা মেলে তাদের মধ্যে রয়েছে হেলেঞ্চা শাক, বন কচু, কলমি, কাটা কচু, হরিশাক, পানিভাংগা, হাগড়া ইত্যাদি শাক।
বছরের নানা সময়ে এদের দেখা মেলে। কোন কোনটা বেশি পাওয়া যায় শীত মৌসুমে। শীত মৌসুমের শাকের মধ্যে রয়েছে নটেশাক, মোরগ শাক, দুধলী, খ্যাটখ্যাটি, বন কচু, চিনিগুড়া ইত্যাদি। বর্ষাকালে পাওয়া যায় তেমন শাকের মধ্যে রয়েছে হেলেঞ্চা শাক, ঢেঁকিশাক, থানকুনি, কলমি, পানিভাঙ্গা ইত্যাদি। বৈশাখ মাস থেকে পাওয়া যায় যেসব শাক তাদের মধ্যে রয়েছে যারকোন, কস্থরী, তেলাকোচা, পিপুল, কানাইশাক, গিননারিস, হুটকা ইত্যাদি শাক। সারা বছর পাওয়া যায় তেমন অনাবাদি শাকও আমাদের কম নয়। এ দলের শাকের মধ্যে রয়েছে থানকুনি, বন কচু, বিষ কচু, গন্ধভাদালী, রসুন শাক, কাটানটে, ক্যাথাপাটা, কাটাকচু, নিলিচি, মুনসি শাক, হরিশাক, বনঝুড়ি। এছাড়া অন্যান্য ঋতুতেও পাওয়া যায় অন্যান্য কোন কোন শাক। প্রকৃতির ভান্ডার থেকে কুড়ানো এসব শাক কেবল কুড়ানী বা হত-দরিদ্র গৃহে খাদ্যের উৎস তা কিন্তু নয়। এসব কুড়ানো কোন কোন শাক চলে যায় শহরের কাঁচা বাজারগুলোতেও। কোন কোন শাক চলে যায় দূর দূরান্তে বিক্রির জন্য এমনকি রাজধানীতেও। কুড়িয়ে পাওয়া শাকের মধ্যে শহর বন্দরে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় কলমি, খানকুন, বথুয়া, ঢেঁকিশাক, গিমা শাক, যারকোন, কঁচু ইত্যাদি শাক। বলা বাহুল্য গ্রামের হত দরিদ্র ছাড়াও কৃষান-কৃষানি বা তার ছেলে-মেয়েরা নিজেদের খাওয়ার তালিকায় শাক রাখার জন্য এসব শাক সংগ্রহের জন্য ৩/৪ কিলোমিটার পাড়ি জমায়। এমনকি কুড়িয়ে পাওয়া এসব শাক বিক্রি করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তাদের বিচরণ এক জেলা থেকে আরেক জেলায়।
খাবার তাগিদে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন খাবার তালিকায় শাক এক অতি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। বহু দরিদ্র পরিবারে দিনে একাধিক বেলা নানা উপায়ে শাককে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কখনো শাক এককভাবে একটি আইটেম হিসেবে কখনো আবার একাধিক শাক একত্রে মিশিয়ে বা কখনো মাছের সাথে শাক মিশিয়ে রান্না করা হয়। যেসব পরিবারে আলাদা সবজি কেনার সাধ্য নেই বা খুবই কম সেসব পরিবারে কুড়িয়ে পাওয়া শাক সবজির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শাক যে কত ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ভক্ষণ করা হয় তা দেখলে অবাক হতে হয়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কোন কোন শাক ভাতের সাথে দিয়ে সেদ্ধ করে ভর্তা বানিয়ে খাওয়া হয়। অনেক সময় ভাপ দেওয়ার পর শাক হাতে বা পাটায় পিষে ভর্তা বানানো হয়। ভর্তা তৈরি করে যেসব শাক বেশি খাওয়া হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কস্থরি পাতা, খানকুন পাতা, দন্ডকলস, কলমি শাক, সেঞ্চিশাক, হেলেঞ্চা শাক, কচু শাক ইত্যাদি। শাক কুচি কুচি করে কেটে কড়াইয়ে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, তেল আর নুন সহযোগে ভাজি করে খাওয়া যায় প্রায় সব প্রকার শাকই।

মাছের সাথে শাক মিশিয়ে চড়চড়ি রান্নার প্রচলনও রয়েছে বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে। ছোট মাছের সাথে শাক মাখিয়ে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, হলুদ, তেল ও লবণ মিশিয়ে পানি যোগ করে ঢেকে জ্বাল দিয়ে মাছ সেদ্ধ হয়ে গেলে নিচে একটু রসা রসা ভাব থাকলে তাহলো চড়চড়ি। এরকম চড়চড়ি রান্নার জন্য ব্যবহৃত শাকগুলো হলো কাটাখুড়ে, কলমি,হেলেঞ্চা শাক ইত্যাদি। অনেক শাক আবার পাটায় বেটে সাথে চালের গুড়ো মিশিয়ে সাথে গন্ধভাদুলি’র পাতা, ডাল, কালোজিরে, হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন বেটে প্রয়োজন মত লবণ যুক্ত করে অল্প তেলে কড়াইয়ে ভাজা হলে যে বড়া তৈরি হয় একে গন্ধভাদালের বড়া বলা হয়। যা গ্রাম-গঞ্জের বাজারের বড়া ভাজা দোকানে প্রিয় খাবার হিসাবে প্রচলিত। শাকের আরেক প্রকার রান্নাকে শাকের পিঠালু বলা হয়। হলুদ, মরিচ, মসলা বাটা একটু পানিতে কসিয়ে তার মধ্যে শাক কসিয়ে পানি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। শাকে বলক এলে তাতে আটা বা চালের গুড়ো গুলিয়ে শাকের মধ্যে ঢেলে দিয়ে নেড়ে কিছুক্ষণ জ্বাল দেওয়া হয়। এতে শাক আর চালের আটা সেদ্ধ হয়ে পিঠালু রান্না হয়ে যায়। অনেক অনাবাদি কুড়িয়ে আনা শাক আবার আবাদি শাকের সাথে মিশিয়ে রান্না করা হয়। নানা রকম শাক যেমন- গিমাশাক, সজিনা শাক আর গিরমি তিতা শাক কড়াইতে তেল ছাড়া চান্নি করা হয়। ছোট চিংড়ি মাছ ভেজে আধা পেষা করা হয়। অতঃপর কড়াইয়ে তেল গরম করে রসুন ছেঁচে গরম তেলে দিয়ে মাছ ও শাক একসাথে কড়াইতে দিয়ে লবণ চেখে নামিয়ে ফেলা হয়। এটি একটি রেসিপি মাত্র। শাক আর মাছ দিয়ে এরকম বহু ভিন্ন ভিন্ন রেসেপি করে নেয় গ্রামের মহিলারা। কত রকমের ভিন্ন ভিন্ন মিশ্রণে যে শাক রান্না করা হয় তার কোন ইয়ত্তা নেই। শুটকির সাথে মিশিয়ে, চিংড়ি দিয়ে কিংবা অন্যান্য ছোট মাছের সাথে শাক মিশিয়ে রান্না করার নানা কৌশল গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। এসবের বাইরে রয়েছে নানা রকম শাকের ঘন্ট।
এক শাকের সাথে অন্য শাক মেশানোর বিষয়টি কোন সহজ কাজ নয়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গ্রামের মহিলারা ঠিক জানেন কোন শাকের সাথে কোন শাক মেশানো যায়। সব শাকেরতো আর এক রকমের স্বাদ নয়। কোনটা মিঠা তো কোনটা আবার তিতা, কোনটা পানসে স্বাদের তো কোন কোনটা আবার নোনতা। কোন শাক অন্য কোনটির সাথে মেশালে স্বাদ বৃদ্ধি পাবে সে জ্ঞানও কিন্তু আমাদের অক্ষর জ্ঞানহীন মহিলাদেরও রয়েছে। হয়তো খাদ্যে শাকের কি গুণাগুণ সে খবর তাদের কাছে নেই, তবে শাক যে দেহের জন্য বড় প্রয়োজন সেটি মনে হয় তারা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে জেনে গেছে। নানা রকম শাক গ্রহণ করে বলেই গ্রামেগঞ্জে দরিদ্র -হতদরিদ্র মানুষের পেটের পীড়া কম হয়। এমনকি ক্যানসারসহ নানা রকম অসুখের হাত থেকে তারা রক্ষা পায়। নানা রকম পুষ্টি উপাদানের চাহিদাও তাতে পূরণ হয়। আর এজন্যই হয়তো গ্রামের কৃষক নারী চৈত্র সংক্রান্তিতে শাক কুড়াতে বেড়োয়। নিয়ম আছে তাকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। আবাদী নয়, অনাবাদী, অর্থাৎ রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, চকে আপনজালা শাক তুলতে হবে। গ্রামে নারীর এই শাক তোলার অধিকার সামাজিকভাবে স্বীকৃত। নারীর দেখার বিষয় হচ্ছে যেই শাক তাঁরা খুঁজছেন সেই শাক আছে কিনা। ধনী পরিবারের নারীরাও এতে সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি নিজে শাক তুলতে বের না হলেও তার আশেপাশে যারা গরিব নারী আছেন তাঁদের মাধ্যমে শাক তুলিয়ে আনেন। মনে রাখতে হবে বলা হয় ‘শাক তোলা’; শাক ‘কাটা’ নয়। কখনোই তারা পুরো গাছটি উপড়ে ফেলে শাক আনবেন না। অতি যত্ন করে পাতাটি তুলে আনবেন। গাছ যেমন আছে তেমনই থাকবে। একদিকে যেমন অনাবাদী হতে হবে, অন্যদিকে চৌদ্দ রকমের শাকের ওপরও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে ‘চৌদ্দ’সংখ্যাটা প্রতীকী। বেশী পাওয়া গেলে আরও ভাল। এই চৌদ্দ রকম শাক পাওয়াই এখন কঠিন হয়ে গেছে। চৈত্র মাসে পাওয়া যায় এমন শাক হচ্ছে নেটাপেটা, কলমি, হেলেঞ্চা, গিমা, দন্ডকলস, কচু শাক, তেলাকুচা, ঢেঁকি শাক, হেঞ্চি, বতুয়া, খারকুন, খুইরাকাটা, পিপুল শাক, কস্তুরি, থানকুনি, খেতাফাটা, পাট শাক, শুশ্নি, নুনিয়া, হাগড়া ইত্যাদি।
দিন দিন পতিত জমি কমে যাচ্ছে। ব্যবহার করা হচ্ছে মাঠে নানা রকম আগাছানাশক। আগাছানাশক নির্বিচারে মেরে ফেলছে আগাছাসহ নানা রকম গুল্ম আর তৃণজাতীয় উদ্ভিদ। ফলে নষ্ট হচ্ছে নানা রকম শাকও। তাছাড়া ফসলের মাঠে থাকা আগাছা পরিষ্কার করে ফেলা হচ্ছে। প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদ করার প্রবণতা এসব প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো আগাছার আশ্রয় নষ্ট করে দিচ্ছে। নানা রকম কল কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য বিষিয়ে তুলছে মাটি, বায়ু এবং পানি। ফলে অনেক ডোবা নালায় জন্মানো শাক খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের শাকের প্রাকৃতিক উৎস অনেকটাই যেন বিপর্যয়ের মুখে।

নিরাপদ স্থান থেকে সচেতন ভাবে শাক তুলে না আনলে তা কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। এসব বিষয় মাথায় রেখে সাবধানতার সাথে আমাদের প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো শাক সংগ্রহ করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে শাক আমাদের উত্তম খাদ্য ও আঁশের উৎস। তাছাড়া শাক অনেক রকম খনিজ পদার্থ ও ভিটামিনেরও উৎস। ফলে নানা রকম শাক আমাদের দেহের পুষ্টি চাহিদা মেটাবার একটি অন্যতম উপায়।

Stay Connected
16,985FansLike
2,458FollowersFollow
61,453SubscribersSubscribe
Must Read
Related News

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here