হ্যালো 24 নিউজ।। অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার বাংলাদেশের চিকিৎসাজগতে বিশেষ করে শিশুচিকিৎসার ক্ষেত্রে একজন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে অতিপরিচিত মুখ। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তার রোগী ও ছাত্রছাত্রীর মাঝেও ডা. সাহিদা আখতার উৎকৃষ্ট মানবিক গুণাবলির জন্য সমাদৃত ছিলেন। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ১ মে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার ফুলার রোডের বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর।
তিনি ১৯৬১ সালে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের সবাই তাকে আন্জু বলে ডাকতেন। অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছাত্রজীবনে মেধাবী ছিলেন। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এই মানবিক ব্যক্তিত্ব স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। সাহিদা আখতার এই কলেজের পঞ্চম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস ও সার্জনস থেকে সফলতার সঙ্গে এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পেশাগত অনেক উচ্চতর প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন।
তিনি ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিকস বিভাগের অধ্যাপক এবং বারডেম জেনারেল হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন প্রথিতযশা শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেখানে কর্মরত থেকে অবসরে যান। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতালেও কাজ করেছেন। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য :স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল (অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন, ইন সার্ভিস ট্রেইনি), ঢাকা শিশু হাসপাতাল, আইপিজিএমআর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়), ডা. কাশেমস ক্লিনিক ও হাসপাতাল, কুষ্টিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (লেডি ডাক্তার) ইত্যাদি।
সাহিদা আখতার ছিলেন বাংলাদেশের একজন অসামান্য বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিশু বিশেষজ্ঞ, যিনি বিগত তিন দশক ধরে নবজাতকদের জন্য অক্লান্ত সেবা দিয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন এ দেশে নিউবর্ন স্ট্ক্রিনিং টেস্টের একজন পথিকৃৎ। নিউবর্ন স্ট্ক্রিনিং হলো জেনোমিক মেডিসিনের একটি অংশ, যার মাধ্যমে শিশুর জন্মের পরপরই নির্দিষ্ট কিছু বংশগত রোগ বিশেষ করে যেগুলোর চিকিৎসা প্রথমেই শুরু করলে সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব, সেসব রোগের জন্য পরীক্ষা করে দেখা হয়। নিউবর্ন স্ট্ক্রিনিং টেস্টের মধ্যে রয়েছে :টিএসএইচ, ১৭ ওএইচ-পি, জি৬-পিডি, টোটাল গ্যালাটোজ, পিকেইউ, এমএসইউডি, আইআরটি স্ট্ক্রিনিং, বিটিডি স্ট্ক্রিনিং ইত্যাদি।
শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ, হাঁপানি, বুকের দুধ খাওয়ানোর অনুশীলন, নবজাতকের প্রয়োজনীয় যত্ন, জন্মের সময় নবজীবন সঞ্চার, উন্নত কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট, এইচবিবি (শিশুদের শ্বাস নিতে সহায়তা), ইসিডি (প্রাথমিক শৈশব বিকাশ), পিএনডিএ (পেরিনিটাল ডেথ অডিট) সম্পর্কিত নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে একজন চিকিৎসক হিসেবে তার দক্ষতা বাড়িয়ে তোলেন। পাশাপাশি এগুলো তার গবেষণার ক্ষেত্রও সমৃদ্ধ করে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাহিদা আখতারের চিকিৎসাবিজ্ঞানে দক্ষতার কারণে তো বটেই, তাকে সবাই মনে রাখবেন একজন ‘মানবিক চিকিৎসক’ হিসেবে। গত প্রায় তিন দশক ধরে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন নবজাতকদের রোগাক্লান্ত মুখে হাসি ফোটাতে। নিয়মিত চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি নিবিড় বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক সচেতনমূলক কর্মকাণ্ডে ছিলেন সদা সক্রিয়।
শিশুদের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মাতৃদুগ্ধপানে মায়েদের উদ্বুদ্ধকরণ সচেতনমূলক কর্মসূচিতে ডা. সাহিদা আখতারের রয়েছে বিশেষ অবদান। শিশুস্বাস্থ্যের নানা বিষয় ছাড়াও অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন, এন্ডোক্রাইনোলজি এবং জিনোমিক্সও ছিল তার আগ্রহের ক্ষেত্র।
গতানুগতিক চিকিৎসা-ধারার বাইরে তিনি ছিলেন একজন অনুসন্ধানী চিকিৎসক। শিশুদের শুধু রোগী নয়; দেখতেন একজন মানুষ হিসেবে। সে যে ধর্মেরই হোক, যে জাতেরই হোক, যে পেশারই হোক কিংবা ধনী অথবা গরিব। তার কাছে সবাই ছিল সমান। তিনি একই রোগীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতেন, বোঝার চেষ্টা করতেন তাদের সমস্যা। যতক্ষণ পর্যন্ত শিশুটি ভালো না হতো, ততক্ষণ তিনি তার সর্বশক্তি, শ্রম, মেধা, এমনকি অর্থ দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতেন।
চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি সাহিদা আখতার ছিলেন একজন খ্যাতিমান গবেষক। চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন সচেতন সমাজ গবেষক। ডা. সাহিদা আখতার দেশে এবং দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশে চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং মৌলিক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন।
তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক। সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে এ দেশের গরিব-দুঃখী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে তিনি স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন এ দেশের বরেণ্য গবেষক ও অর্থনীতি শাস্ত্রের অধ্যাপক, শোভন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা আবুল বারকাতকে। মৃত্যুর ক’দিন আগে আবুল বারকাত সম্প্রতি প্রকাশিত ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ- ২০১২ সালে গবেষণায় প্রমাণিত- ২০২১ সালে দৃশ্যমান বাস্তবতা’ বইটি সাহিদা আখতারকে উৎসর্গ করেছেন। তাতে অধ্যাপক বারকাত লিখেছেন, ‘আমার জ্ঞানানুসন্ধান কাজে অনুপ্রেরণার উৎস আমার সহধর্মিণী অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতারকে।’
ডা. সাহিদা আখতারের অকাল মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন মানবিক চিকিৎসককে। আমরা এই দরদি চিকিৎসকের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। মতিউর রহমান ও শিশির রেজা লেখকদ্বয় যথাক্রমে গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা এবং সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি (তথ্যসুত্রঃ দৈনিক সমকাল)